সিলেটি জাতিগোষ্ঠীর ই‌তিকথা

হাসনাইন সাজ্জাদী
  • প্রকাশের সময় : সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ৩৩৬ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে

সিলেটে একটি সম্প্রদায় নিজেদেরকে কামরূপি বা কামাখ্যা জাতি হিসেবে দাবি করে নিজেদেরকে অবাঙালি বলে দাবি করে। কিন্তু কামরূপি জাতি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হবার আগেও যে এখানে নাগা,কুকি, সাওতাল, মুণ্ডা,সরব,বড়ো (টিপরা) ও পাথুরে নামক স্থানীয় জনগোষ্ঠী ছিল তা তারা খেয়াল করেন না। ভারতবর্ষে প্রথম দফায় আর্যরা এসেছে সিলেট চীন সীমান্ত দিয়ে। তারও পূর্বে সিলেটে নানা জাতির আগমন ও মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। বাঙালি জাতি গঠন কালে সমান্তরালে সিলেটেও বাঙালি জাতিসত্তা গড়ে উঠে। তাই মরমি সাধক হাসন রাজা থেকে বাঙালি জাতিসত্তার সংগঠক গুরুসদয় দত্ত সবাই সিলেটিদেরকে বাঙালি বলেছেন। বাঙালি হতে বলেছেন। আমরা যে সিলেটি জাতি, আমাদের রক্তে আসলে কত শত বছরের ইতিহাস আর কত বিচিত্র জাতিগোষ্ঠীর মিশ্রণ মিশে আছে তা নিয়ে গবেষণা করলেই এর সত্যতা জানা যাবে?

আমাদের এই বৃহত্তর ভূখণ্ড, যা আজ বাংলাদেশ নামে পরিচিত, তা হাজার হাজার বছর ধরে বহু জাতিগোষ্ঠীর মিলনক্ষেত্র। এক সময় এসে এই জনপদকে জান্নাতুল বিলাদ বা স্বর্গের নগর বলা হতো। এটা স্মরণাতীত কালের হলেও এর ধারাবাহিকতা আছে এবং সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে বঙ্গভূমি আগে থেকেই পরিচিত। এর অংশীদার সিলেটও। চলুন, ইতিহাসের পাতা থেকে তা দেখে নিই। কীভাবে আজকের সিলেটি জাতিসত্তা গড়ে উঠেছে এবং বাঙালি জাতিসত্তা কিভাবে সিলেটের অংশ।

আদি-অস্ট্রাল ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর প্রথম আগমন

ইতিহাসের সময়রেখায় প্রায় ৬ হাজার বছর আগে আমাদের এই ভূমিতে প্রথম পা রাখে আদি-অস্ট্রাল জাতিগোষ্ঠী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আসা এই জনগোষ্ঠী নব্য প্রস্তর যুগের মানুষে ছিল। তারাই এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসী। আমাদের পরিচিত সাঁওতাল, মুণ্ডা, শবর, কোলের মতো আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো বিবর্তনধারায় তাদেরই উত্তরসূরী।

মজার ব্যাপার হলো, বাংলা ভাষার অনেক সাধারণ শব্দ, যেমন ‘চাল’, ‘ডাল’, ‘শিমুল’—এই শব্দগুলোর উৎস আদি-অস্ট্রাল ভাষা থেকে এসেছে বলে গবেষণা আছে।

তাদের আগমনের প্রায় এক থেকে দুই হাজার বছর পর, অর্থাৎ প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার বছর আগে দক্ষিণ ভারত, শ্রীলঙ্কান ও আফ্রিকা থেকে আসে নানা জনগোষ্ঠী। তাদের মধ্যে দক্ষিন ভারতের দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী অন্যতম।

এই দ্রাবিড়রা আবার সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা। তারা কৃষিকাজ ও নগর সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কয়েকটি আদিম জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণই আমাদের জাতিগত পরিচয়ের প্রথম ধাপ।
তাদের হাতেই সিলেটি জাতিগোষ্ঠী এবং বিবর্তন ধারায় কামরূপী জাতিগোষ্ঠীর ভিত রচিত হয়।

শক হুন, আর্য ও মোঙ্গলীয়দের আগমন মধ্যম পর্যায়

মধ্য এশিয়ার যাযাবর গোষ্ঠী শক ও হুন জনগোষ্ঠী। শকরা আসে প্রায় ২০০০ বছর আগে আর হুনরা আসে ১৫০০ বছর আগে। তাদের আগমনের ফলে এই অঞ্চলের সংস্কৃতিতে নতুন বৈচিত্র্য যুক্ত হয়। তারা স্থানীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে নিজেদের পরিচয়কে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিশিয়ে দেয় এবং স্থানীয়দের পেশা ও জীবন যাত্রাকে সমৃদ্ধ করে।

হুনদের সাথে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বা ৩৫০০ বছর পূর্ব থেকে আর্যদের আগমন শুরু হয়। পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা এই গোষ্ঠীর আগমনে বাঙালিদের সঙ্গে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং জিনগত বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটে। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্য, আদি-অস্ট্রাল ও দ্রাবিড়দের মিশ্রণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সমৃদ্ধ হয়। এভাবেই বাঙালি জাতিসত্তায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়।

এর প্রায় সমান্তরালে, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই পূর্ব দিক থেকে মোঙ্গলীয় এবং রাশিয়ান জনগোষ্ঠীর আগমন শুরু হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব এবং পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের মধ্যে এই প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, মণিপুরী, ম্রো-এর মতো জাতিগোষ্ঠীগুলো এই মোঙ্গলীয় ধারায় মিশে গিয়ে তারা নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করে এবং উত্তোরোত্তর বাঙালি জাতি গঠন কালে এরা অংশ নেয়। আবার তাদের কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারাই পাহাড়ের গুহায় বা চূড়ায় আদিম জীবন ধারণে থেকে যায়।

এদের মধ্যে ত্রিপুরা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আসে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মঙ্গোলিয়া থেকে। এদের পর গারোরা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে তিব্বত হয়ে এই অঞ্চলে আসে।

আবার চাকমা ও মারমাদের আগমন ঘটে ৫০০ থেকে ৭০০ বছর আগে। ম্রো জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে একই প্রক্রিয়ায়। সময়কাল প্রায় ৬০০ বছর আগে।

অষ্টম শতাব্দী থেকে বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে আরবরা পূর্ব বাংলায় আসে এবং চীন পর্যন্ত তাদের পথরেখা বিস্তৃত হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর থেকে এই অঞ্চলে মুসলিম শাসনের বিস্তার ঘটে। ফলে আরব, তুর্কি ও পারস্য থেকে আসা মুসলিম জনগোষ্ঠীর লোকেরা স্থানীয়দের সাথে মিশে যায়। যদিও ইরান ও রাশিয়া থেকে আসা আর্য এবং মৈথিলি ব্রাহ্মরা এখানে আগে থেকেই বসবাস করে আসছিল। আরবদের মধ্যে অনেক পীর, দরবেশ, এবং শাসক ছিলেন। এটা ছিল আরব সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার।

পর্তুগিজ, ইংরেজ ও আর্মেনিয়দের আগমন আধুনিক কালে

১৫১৬ খৃষ্টাব্দ থেকেে পর্তুগিজ, ইংরেজ, আর্মেনীয়দের মতো ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠী এখানে আসা শুরু করে। তখনো আধুনিক কাল শুরু হয়নি। তবে এর রেশ আধুনিক কাল পর্যন্ত এসে ঠেকে। বাণিজ্যিক ও শাসনের প্রয়োজনে তারা এখানে আসলেও বিয়ে এবং বসবাসের দ্বারা তাদের রক্ত স্রোত বাঙালির সাথে মিশে যায়।

১৮শ শতাব্দীতে বার্মা থেকে আসা রাখাইন এবং ব্রিটিশ আমলে ভারতের বিহার, উড়িষ্যা ও তামিল নাড়ু সহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা চা শ্রমিকরাও আমাদের জাতিগোষ্ঠীর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।

এই দীর্ঘ পথচলায়, হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে আজকের সিলেটি জাতি, বাঙালি জাতির একটি অবিচ্ছেদ্য ও সমৃদ্ধ এবং মিশ্রিত জাতিসত্তায় একাত্ম হয়ে পড়ে। এখন সিলেটি নন-সিলেটি সবাই বিদেশিদের সঙ্গে মিশে গিয়ে বাঙালি জাতি
হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
বাঙালি এখন কেবল একক কোনো জাতি বা একক গোষ্ঠী নয়। আমরা এখন একক কোনো জাতির উত্তরসূরি নই, বরং বিভিন্ন সংস্কৃতির এক বিশাল এবং প্রাণবন্ত মেলবন্ধন ঘটেছে আমাদের মধ্যে।
আমাদের এই মিশ্র ঐতিহ্যই আমাদেরকে এখন বাঙালি পরিচয়ে অনন্য করে তুলেছে। আমাদের এই বহুবিচিত্র ইতিহাস বাঙালি জাতিসত্তার গৌরব।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ