আগামী ডিসেম্বর পূর্ণ হবে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা ‘সাম্যবাদী’ রচনার একশত বছর। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে তাঁর নিজের সম্পাদিত লাঙ্গল পত্রিকায় প্রকাশিত এই কবিতাটি শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন। মানবমুক্তি, সাম্য, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে এই কাব্যিক উচ্চারণ আজও তাজা, প্রাসঙ্গিক এবং অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয়। নজরুল তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠে সমাজের অসাম্য, জাত-পাতের বিভাজন, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও শ্রেণিভেদকে ভেঙে যে মানবিক ভবিষ্যতের ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সাম্যবাদী’ তারই শীর্ষনির্ঘোষ।
কবিতার প্রেক্ষাপট
বাংলা সমাজ ২০শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নানা টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল। একদিকে উপনিবেশিক শোষণ, অন্যদিকে সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব— জাতিভেদ, সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার, নারীর অধিকারহীনতা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য। এ সময়ে নজরুল ছিলেন নবযুগের দূত, যিনি একসাথে কবি, সংগীতজ্ঞ, নাট্যকার, প্রবন্ধকার ও রাজনৈতিক কর্মী। ‘সাম্যবাদী’ রচনার মাধ্যমে তিনি কেবল একটি সাহিত্যকর্মই দেননি, বরং যুগের জন্য এক মহান দর্শন উপহার দিয়েছিলেন।
কবিতার গঠন ও বৈশিষ্ট্য
‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি ১১টি এপিসোডে বিন্যস্ত। প্রতিটি এপিসোডে তিনি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের সমতার কথা বলেছেন।
প্রথম অংশে কবি ঘোষণা করেন— তিনি মানুষের গাত্রবর্ণ, জাত, ধর্ম কিংবা লিঙ্গ দিয়ে কোনো ভেদ মানেন না।
পরবর্তী অংশগুলোতে ফুটে ওঠে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতীক, ঐতিহাসিক চরিত্র ও পৌরাণিক উপমার মিশেল। নজরুল এখানে কেবল রাজনৈতিক সাম্য বোঝাননি, বরং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এক মহান ঐক্য কল্পনা করেছেন।
শেষাংশে কবিতাটি রূপ নেয় এক মহাজাগতিক মেলবন্ধনে, যেখানে সব মানবসত্তা, সব জাতি, সব সম্প্রদায় এক মহাসমারোহে যুক্ত হয়।
মানবসত্তার বিজয়ের কাব্য
নজরুলের এই কবিতা মূলত মানবসত্তার জয়গান। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষের আসল পরিচয় হলো তার মানবিকতা।
মানুষ জন্মগতভাবে কোনো জাতপাত বা ধর্মের সীমায় আবদ্ধ নয়।
মানুষের অন্তরাত্মাই তার সত্য পরিচয়, বাহ্যিক চিহ্ন নয়।
তাই তাঁর ঘোষণা— শূদ্র-ব্রাহ্মণ, মুসলমান-হিন্দু, পুরুষ-নারী— কারো মধ্যে কোনো ভেদ নেই।
এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু সামাজিক সাম্যের নয়, বরং মানবতাবাদী দার্শনিক চেতনার প্রতিফলন।
শিল্পের অমর ঝুল বারান্দা
‘সাম্যবাদী’ কেবল রাজনৈতিক বা সামাজিক আহ্বান নয়, এটি শিল্পের দিক থেকেও অনন্য।
নজরুল তাঁর কবিতায় একদিকে আরব-পারস্যের বীর, অন্যদিকে বৈদিক যুগের দেবদেবী, আবার পাশ্চাত্যের সাহিত্যিক প্রতীককেও জুড়ে দিয়েছেন।
এই সমন্বয় কবিতাকে দিয়েছে এক বিশ্বজনীন শিল্পরূপ।
কবিতার ছন্দ, গতি ও অলঙ্কারশক্তি আজও পাঠককে মুগ্ধ করে।
তাই একে বলা হয় “শিল্পের অমর ঝুল বারান্দা”— যেখান থেকে মানবসভ্যতার সব কণ্ঠস্বর এসে মিলেছে।
বাংলা সাহিত্যে বিরল অর্জন
বাংলা কাব্যে বিদ্রোহী কবির আগমন ছিল এক বিরল বিস্ময়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতোই ‘সাম্যবাদী’ নজরুলকে দিয়েছে অমরত্ব। তবে ‘বিদ্রোহী’ ছিল ব্যক্তিসত্তার মুক্তি ঘোষণা, আর ‘সাম্যবাদী’ হলো সমষ্টিগত মানবমুক্তির ইশতেহার।
রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ ছিল সৌম্য ও সৌন্দর্যনিষ্ঠ; নজরুলের মানবতাবাদ ছিল সংগ্রামী ও দণ্ডায়মান।
তাই এই কবিতা বাংলা সাহিত্যে একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক— দর্শন, রাজনীতি ও নান্দনিকতার সম্মিলন।
শতবর্ষ পরেও প্রাসঙ্গিকতা
আজও পৃথিবী ভরে আছে বৈষম্য, দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও ধর্মীয় উগ্রতায়। এ সময়ে নজরুলের আহ্বান নতুন করে আমাদের কানে বাজে—
মানুষে মানুষে ভেদরেখা মুছে ফেলার প্রয়োজন।
নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ধর্ম যেন বিভাজন নয়, মানবিকতার উৎস হয়।
তাঁর শতবর্ষপ্রাচীন কবিতা তাই কেবল ইতিহাস নয়, আজও এক চলমান ডাক।
নজরুলের “গাহি সাম্যের গান” কাব্যের মাহাত্ম্য
কাজী নজরুল ইসলামের “গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নহে কিছু মহীয়ান” উচ্চারণ শুধু কবিতার পঙ্ক্তি নয়—এটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক বিপ্লবী সত্যের প্রকাশ। এর মাহাত্ম্য আমরা কয়েকটি দিক থেকে দেখতে পারি—
১. মানবকেন্দ্রিক দর্শন
এই কবিতায় নজরুল ঘোষণা দেন যে মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নেই।
কোনো দেবতা, কোনো জাতি, কোনো ধর্ম বা ক্ষমতা মানুষের ওপরে নয়।
এর মাধ্যমে তিনি মানুষকেই করেছেন বিশ্বসত্যের কেন্দ্রবিন্দু।
এমন দৃষ্টিভঙ্গি শুধু সাহিত্যে নয়, দর্শনেও এক গভীর মানবতাবাদী অবস্থান।
২. সাম্যের দর্শন
নজরুলের কবিতার মূল প্রেরণা সাম্যবাদ।
ধনী-গরিব, জাত-পাত, নারী-পুরুষ—সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী।
তিনি দেখিয়েছেন, বৈষম্যের সব দেওয়াল ভেঙে এক নতুন সমাজ গড়তে হবে।
এই ঘোষণা বাংলায় সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল শক্তি এনে দেয়।
৩. বিপ্লবী চেতনা
নজরুল শুধু কাব্যে নয়, জীবনে-রাজনীতিতেও বিদ্রোহী ছিলেন।
তাঁর এই উচ্চারণ নিপীড়িত ও বঞ্চিতদের শক্তি যুগিয়েছে।
উপনিবেশিক শাসন, সামন্তবাদ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ ছিল বজ্রধ্বনির মতো।
৪. শিল্প ও মানবতার সমন্বয়
“গাহি সাম্যের গান” কেবল সমাজ পরিবর্তনের আহ্বান নয়, এটি কাব্যশিল্পেরও অনন্য নিদর্শন।
ছন্দ, অনুপ্রাস ও অনির্বাণ উদ্দীপনা পাঠককে আবিষ্ট করে।
কবিতা এখানে হয়ে ওঠে শুধু অনুভব নয়, বরং সংগ্রামের অস্ত্র।
৫. আজকের প্রাসঙ্গিকতা
একশ বছর পেরিয়েও দুনিয়া ভরা অন্যায়, বৈষম্য, ধর্মীয় বিভাজন ও যুদ্ধ।
নজরুলের ডাক আমাদের শেখায়—মানুষই সর্বোচ্চ, তার ওপরে কোনো বিভেদ টিকে থাকতে পারে না।
মানবিক সমাজ গড়ার জন্য তাঁর কণ্ঠস্বর আজও জরুরি।
“গাহি সাম্যের গান” মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চিরন্তন সনদ। এটি শুধু বাংলা কবিতার নয়, সমগ্র মানবতার অর্জন। নজরুল এই কবিতার মাধ্যমে দেখিয়েছেন—
” মানুষের ঊর্ধ্বে আর কিছু নেই এবং সাম্য ও মানবিকতাই হলো সভ্যতার চূড়ান্ত গন্তব্য।”
উপসংহার
কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাম্যবাদী’ কবিতা শতবর্ষ পরেও এক চিরন্তন মহাকাব্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এটি একদিকে মানুষের মুক্তির সনদ, অন্যদিকে শিল্পের মহার্ঘ স্থাপত্য। নজরুলের উচ্চারণ আজও আমাদের শেখায়— সাম্যের পথে হাঁটাই মানবতার ভবিষ্যৎ। তাই এই কবিতাকে আমরা শুধু সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবে নয়, বরং মানবসভ্যতার অমূল্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করি।
—